শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৮ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ওসমানী জাতীয় স্মৃতি পরিষদ-এর বিশেষ বাণী জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্য হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খ. ম. আমীর আলী ছাত্র বৈষম্য আন্দোলনে আহতদের জন্য আর্থিক সহায়তা নিয়ে পাশে বিএনপি নেতা মোঃ সাইফুল ইসলাম নরসিংদীর মনোহরদীতে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানক্লাব ‘নেবুলাস’-এর যাত্রা শুরু প্রথমবারের মতো সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গার্মেন্টস ব্যবসায়িদের নিঃস্ব করে কোটি টাকা প্রতারণা করে লাপাত্তা কৃষক লীগ নেতা হান্নান শেখ! টাকার বিনিময়ে বিদ্যুতের তার খাম্বা মিটার এনে দেন ইলেকট্রিশিয়ান জুলিয়ান! নবান্ন উৎসব ঘিরে জমে উঠেছে কালাইয়ে মাছের মেলা কটিয়াদীতে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের সম্বর্ধনা জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকতে হবে: রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু
বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কারণ কী?

বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কারণ কী?

ভিশন বাংলা ডেস্কপ্রগতিশীল সামাজিক নীতি এবং কিছু ঐতিহাসিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি থেকে বাংলাদেশ এখন উচ্চাকাঙ্ক্ষী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ঐহিতাসিক যেসব কারণে পথ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে, সেগুলো কি বাংলাদেশ অগ্রাহ্য করতে পারবে?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার অন্যতম এবং অপ্রত্যাশিত সাফল্যের গল্প হয়ে গেছে বাংলাদেশ। এক সময় এই অঞ্চলটি ছিল পাকিস্তানের দরিদ্রতম এলাকা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দারিদ্র্য এবং দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া দেশটি অর্থনীতিতে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন প্রবৃদ্ধিতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়, তখন তাকে অপ্রত্যাশিত সাফল্য হিসেবেই ধরা হয়েছিল।

কিন্তু ওই সময় থেকে প্রতি বছর পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি আড়াই শতাংশেরও বেশি হচ্ছে। চলতি বছর এই প্রবৃদ্ধি ভারতের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন ১.১ শতাংশ। যেটা পাকিস্তানের দুই শতাংশের চেয়ে অনেক কম। এর প্রভাবে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের প্রতি বছরের ৩.৩ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি হারে বাড়ছে।

আশা করা যাচ্ছে, মাথাপিছু ডিজিপির দিক থেকে বাংলাদেশ ২০২০ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাবে। এমনকি ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেও যদি সমতা আসে।

বাংলাদেশ কীভাবে এটা করল?

ঐতিহাসিক নানা অনুঘটক বিবেচনা করে এর কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব পাওয়া যায় না। তবে কিছু ধারণা করা যায় মাত্র। তবে আমার ধারণা, নারীর ক্ষমতায়নের ফলে যে সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে সেটিই অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

আর এই নারীর ক্ষমতায়নের পেছনে সরকারের অবদানের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের শিক্ষার পাশাপাশি ঘরের ভেতরে এবং বাইরে নারীদের অধিকার বোধ জাগ্রত করতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। আর শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে। আর এখন বাংলাদেশের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। এটি ভারতে ৬৮ এবং পাকিস্তানে ৬৬ বছর।

তৃণমূল পর্যায়কে অন্তর্ভুক্ত করতে নেয়া অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলোর জন্য বাংলাদেশের সরকারকে কৃতিত্ব দিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও তার চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ৩৪.১% প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যাংক হিসাবধারীরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে টাকার লেনদেন করেছেন। যেখানে পুরো এশিয়াতে এর সংখ্যা ২৭.৮ শতাংশ। তার ওপর মাত্র ১০.৪ শতাংশ ব্যাংক হিসাব পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে, যেখানে পাশের দেশ ভারতে এর পরিমাণ প্রায় ৪৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের অগ্রগতির আরেকটা আংশিক ব্যাখ্যা হতে পারে তৈরি পোশাক শিল্প। বেশ কিছু কারণে এই শিল্প ব্যাপক অগ্রগতি করেছে। এর একটি কারণ হলো, বাংলাদেশের প্রধান পোশাক কারখানাগুলো ভারতের তুলনায় অনেক বড়, যেগুলোতে শ্রম আইন একটু ভিন্ন ধরনের।

প্রতিটি শ্রম বাজারের জন্যই আলাদা আইন থাকতে হয়। কিন্তু ভারতে ১৯৪৭ সালে করা শিল্প নিরোধ আইন অনুযায়ী কারখানাগুলোকে তাদের ইচ্ছামাফিক শ্রমিকদের নিয়োগ এবং সংখ্যা বৃদ্ধিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য হিতে বিপরীত হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার কয়েক মাস আগে এই আইনটি জারি করা হয়। আর ভারত এবং পাকিস্তান- দুই দেশেই এই আইনটি প্রযোজ্য হয়। কিন্তু পাকিস্তানে সামরিক শাসনামলে ১৯৫৮ সালে ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে অধৈর্য হয়ে তা বাতিল করা হয়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশও সে আইন গ্রহণ করে। আর এভাবে বাংলাদেশ উৎপাদন খাতের শ্রমিকদের জন্য তুলনামূলক ভালো পরিবেশের নিশ্চয়তা করতে পেরেছে যেটা আবার কারখানাগুলোকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ চাকরিরও সুযোগ তৈরি করছে এটি। তবে পেশাগত ঝুঁকি থেকে শ্রমিকদের রক্ষায় বাংলাদেশে এখনও শক্তিশালী আইনি কাঠামো তৈরির প্রয়োজন রয়েছে।

প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য টেকসই হবে কি না। এখন অবধি বাংলাদেশের অগ্রগতি চমৎকার। তবে এর কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। নীতি নির্ধারকদেরকে এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

যেমন, যখন একটি দেশের অর্থনীতি অগ্রগতির পথে যাত্রা শুরু করে তখন দুর্নীতি, জোটবদ্ধতা এবং বৈষম্য বাড়ে। একে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অগ্রগতির চাকা ধীর হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

পাশাপাশি বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বাধা রয়েছে এবং একটি একটি বড় হুমকি। তারা যে কোনো প্রগতিশীল সামাজিক সংস্কারের উদ্যোগকে শুরুর দিকে বাধা দেয়। বিনিয়োগের বিপরীতে এই ধরনের কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি গুরুতর ও দীর্ঘ মেয়াদি বাধা। এই সমস্যা ছোটখাট কোনো বিষয় না। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে শক্তিশালী অর্থনীতিও ধসে পড়েছে এ কারণে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক হাজার বছর আগে আরবের গোত্রগুলো এই অঞ্চল শাসন করেছে এবং তাদের মতো করে অর্থনীতিকে বিকশিত করেছে। তখন দামেস্ক এবং বাগদাদের মতো শহরগুলো ছিল বিশ্ব সংস্কৃতি, গবেষণা এবং আবিস্কারের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু যখন ধর্মীয় মৌলবাদ বিকশিত হয় তখন এই স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে।

পাকিস্তানের ইতিহাসও তাই। শুরুর বছরগুলোতে দেশটির অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো করছিল। তখন তাদের মাথাপিছু আয় ভারতের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তখন লাহোরের মতো শহরগুলো বহুমাত্রিক সংস্কৃতির, শিল্প এবং সাহিত্যের কেন্দ্র হয়ে উঠে।

কিন্তু সেনা শাসন চলে আসার পর ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হয় এবং ধর্মীয় উগ্রবাদী উপদলগুলো মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। ২০০৫ সালে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায় ভারত। সেই থেকে এই ব্যবধান এখন বাড়ছেই।

এই হুমকি কোনো একটি অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য, তা নয়। গত কয়েক বছর আগেও ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদার ভারত বছরে আট শতাংশ হারের চেয়ে বশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তবে বর্তমানে হিন্দু মৌলবাদী শক্তি যারা সংখ্যালঘু এবং নারীদের প্রতি বৈষম্য তৈরি করছে, যারা উচ্চ শিক্ষায় বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ছুড়ে ফেলার কাজ করছে- তারা অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রেও হুমকি তৈরি করছে।

একই ভাবে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হওয়া পর্তুগালও খ্রিস্টান মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে তার প্রভাব প্রতিপত্তি হারায়।

এসব অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তবে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হুমকির বিষয়ে সচেতন এবং এ বিষয়ে তার মনোভাবও কঠোর। এ ক্ষেত্রে এশিয়ার সাফল্যের গল্প হতে বাংলাদেশ একটি উদাহরণ হতে পারে, যা দুই দশক আগেও কল্পনা করা যেত না।

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক।

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2011 VisionBangla24.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com